আমাদের অবস্থা ইকুয়েডরের মতো ভয়াবহ হবেনা

গোলাম সারোয়ার :: পৃথিবীর কোন মাটির পরিণতি অন্য মাটিতে খাটেনা। কোন জাতির ইতিহাস অন্য জাতিতে মিলেনা। গোষ্ঠীভিত্তিক আধ্যাত্মিক এশিয়ায় গণহারে লাশ ফেলে কেউ পালাবেনা। এদেশের কোন ভাই-বোন ভাইবোনের লাশ ফেলে পালাবেনা, কোন মা তাঁর সন্তানের লাশ ফেলে পালাবেননা এবং কোন সন্তানও তার মা-বাবার লাশ পথে ফেলে রেখে পালিয়ে যাবেনা।

যারা পারিবারিক জীবনযাপন করেনি, গোষ্ঠীর সম্পর্ক মেনটেইন করেনি, তাদের কথা ভিন্ন; কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের জন্যে তাদের গোষ্ঠী কাঁধ পেতে দিবেন। তাই বলছি, ইকুয়েডরের মতো এদেশের পথে পথে লাশ পড়ে থাকবে,– এ ধারণা ঠিক নয়। এগুলো বলে অযথা আতঙ্ক ছড়াবেন না। এশিয়া আধ্যাত্মিকতার পূণ্যভূমি। এখানে প্রতিটি মৃতদেহ সমাহিত হবে ধর্মীয় সম্মানের সহিত।

বাংলাদেশে বহু লোক করোনা রোগে মারা যায়নি। বহুলোক আক্রান্তও হয়নি এখন পর্যন্ত। আবার এও সত্য, টেস্টের কারণে আমরা বলছি, আমাদের প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে ৮ মার্চ। এর আগে আমরা টেস্টও করিনি, তাই আমাদের ধরাও পড়েনি। এখন টেস্ট যেমন বাড়ছে, রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু বাস্তবতাটা আসলে কি হবে !

বাস্তবতা হলো, এখন পর্যন্ত যত রোগী ধরা পড়েছে, প্রকৃত রোগীর সংখ্যা হবে তার থেকে অনেক বেশি। মানে বাংলাদেশের সব মানুষকে একসাথে টেস্ট করতে পারলে রোগীর সংখ্যা আরো বাড়বে। এটি শুধু বাংলাদেশের জন্যে সত্য না, পুরো পৃথিবীর জন্যে সত্য। কিন্তু সব মানুষকে একসাথে টেস্ট করার ক্ষমতা পৃথিবীর সবদেশ মিলেও এ মূহুর্তে আমাদের নেই।

আজ পর্যন্ত(০৭.০৪.২০২০) সমস্ত পৃথিবীর পজিটিভ করোনারোগীর সংখ্যা হলো, ১৩,৬২,২০০ জন। কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষকে এ মূহুর্তে টেস্ট করতে পারলে রোগী হবে কয়েক কোটি। তাহলে মৃত্যু কেন লাখে লাখে হয়নি! এটির দুটি কারণ হতে পারে। একটি হলো, যত মানুষ মারা যাচ্ছে, সবাই রিপোর্টের আওতায় আসছেনা কিংবা এ রোগে মৃত্যুর হার খুবই কম।

আধুনিক যুগ হলো তথ্যের যুগ। এই যুগে তথ্য লুকিয়ে রাখা কঠিন। সরকারগুলোর একটি প্রচেষ্টা থাকে তথ্য লুকোনোর। সেটা তাঁরা করেন মানুষের মনোবল ধরে রাখার জন্যে, পরিস্থিতি স্টেবল রাখার জন্যে। কিন্তু এযুগে তথ্য লুকিয়ে রাখার তেমন একটা সুযোগ নেই।

৭৮০ কোটি মানুষের এ পৃথিবীর বেশির ভাগের কাছে আছে একটি মোবাইল ফোন। সেটা যদি পঞ্চাশ ভাগও হয়, তবে সেটা হলো  ৩৯০ কোটি। এই ৩৯০ কোটির বেশির ভাগ মানুষের কাছে আছে কোন না কোন একটি সামাজিক মাধ্যম। তার মানে এদের বেশির ভাগ হলো নাগরিক সাংবাদিক। মানে অকালে কারো আশেপাশে একজন মানুষ মারা গেলে তার খবর সামাজিক মাধ্যমে প্রায় আসবেই। সুতরাং এযুগে তথ্য লুকোনোর তেমন একটা সুযোগ নেই। সে হিসেবে বুঝা যাচ্ছে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশে এ রোগে অগণিত মানুষ মারা যাচ্ছেনা। মারা যাচ্ছে ইউরোপ আর আমেরিকাতে, যারা বিশ্ব রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেন। আর মারা যাচ্ছে তাদের সাথে সামরিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক কিংবা অর্থনৈতিকভাবে কাছাকাছি দেশগুলোর মানুষ।

এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলো এ রোগ থেকে এখনো এক রকম নিরাপদ দূরত্বে আছেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ইউরোপের ৪৪ টি দেশের ভিতরে শক্তিশালী দশটি দেশে এ রোগের ভয়াবহতা প্রকট, কিন্তু বাকী ৩২টি দেশ এখনো প্রায় নিরাপদে আছে। মোট কথা পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলোতে এই রোগের তেমন কোন তাণ্ডব এখনো নেই।

এবার আসি আমাদের কথাতে। চীনের উহানে এ রোগ ধরা পড়ে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। তার কয়েক সপ্তাহ পরেই ধরা পড়ে ইউরোপে এবং আমেরিকাতে। নিয়ম মতে আমাদের মানুষও তখন আক্রান্ত হওয়ার কথা।

আমাদের দেশে বহু চাইনিজ আসা যাওয়া করতো হর-হামেশাই। তাঁদের অর্থায়নে কিংবা প্রকৌশলে বহু প্রকল্প আমাদের দেশে চলমান। তিন মাস আগেও আমাদের ডোমেস্টিক সব ফ্লাইটে দশ পনের ভাগ যাত্রী থাকতো চাইনিজ। আবার বাংলাদেশের ইমপোর্টের একটি বড় সোর্স চায়না বলে আমাদের বহু লোক প্রতিদিন চায়নাতে যেতেন এবং আসতেন। আর চট্টগ্রামেতো তাদের বহু লোক হামেশাই হাঁটাচলা করতেন। তাই বলা যায় আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের বেইজ-টাইম হওয়ার কথা জানুয়ারীতেই। আমরা ভুলে বসে আছি, করোনা ভাইরাসের প্রথম প্রকোপ যায় চায়নাতে। অথচ আমরা বেইজ ধরে বসে আছি আমাদের ইতালি ফেরত অভিবাসীদের ঘরে ফেরার সময় থেকে।

এসব হিসাব করে আমাদের আশাবাদ হলো, আমাদের দেশে করোনার তাণ্ডবের সম্ভাবনা খুবই কম। কাল রোগীর সংখ্যা ৩৫ আর আজ ৪১ দেখে অনেকে ভয় পাচ্ছেন। না ভয়ের কিছু নেই। আমাদের রোগী যা আছে তাইই। সংখ্যা বাড়ছে টেস্ট বাড়ছে বলে।

আশার কথা হলো, এ পর্যন্ত আমাদের মৃতের সংখ্যা হলো ১৭ জন, যাদের বেশির ভাগ বয়স্ক এবং অন্যরোগে দুর্বল। আমাদের যখন মৃতের সংখ্যা ১৭, তখন পৃথিবীর সবেচেয়ে সক্ষম দেশ আমেরিকার মৃতের সংখ্যা ১০,৯৬৬, ইতালির ১৬,৫২৩, স্পেনের ১৩,৭৯৮, ফ্রান্সের ৮,৯১১ আর ব্রিটেনের ৫,৩২৩। অথচ যে ইকুয়েডর নিয়ে আমাদের ভয় দেখানো হচ্ছে সে ইকুয়েডরে মৃতের সংখ্যা কিন্তু মাত্র ১৯১ জন !

ভারতের করোনারোগীর মৃত্য নিয়েও আমাদের অনেকে ভয় পাচ্ছেন। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, ১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারতে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৩৭ জন। অথচ দেশটি হলো চীনের সীমান্তে অবস্থিত একটি সামাজিকভাবে দুর্বল দেশ, যে দেশের অধিকাংশ লোক দারিদ্য সীমার নীচে বসবাস করেন। নিয়ম মতে, করোনা চীনের পর হিট করার কথা ভারতে। আর ইতালির ৬ কোটি মানুষের মৃত্যুর হিসাব আমলে নিলে ভারতে মৃত্যু হওয়ার কথা এ পর্যন্ত পৌনে চার লাখ, আর দুর্বল দেশ বলে সেটা হতো আরো তিনগুণ বেশি, মানে প্রায় দশ লাখ। কিন্তু আমাদের মতো আজো খোদা তাদের সহায়।

এসব তথ্য দেখে পৃথিবীর বহু সমর-বিশারদ মনে করছেন, করোনা একটি রাজনৈতিক ভাইরাস। এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাস নিয়ে যে ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো বিশ্ববাজারে চালু আছে সেগুলো হলো; এটি একটি জীবাণু অস্ত্র যা বানিয়েছে চীন। আবার চাইনিজ সমরবিদরা বলছেন, এটি বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের সৈন্যরা এটি চীনে পাঠিয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছে, এটি চীনের বন্যজীব বিক্রির মার্কেট থেকে ছড়িয়েছে। কেউ বলছে, এটি চীনের জীবাণু অস্ত্র তৈরির ল্যাব থেকে লিক হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। যাই সত্য হোক না কেন, আমরা দেখতে পাই এই ভাইরাসের আচার-আচরণ রাজনৈতিক।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে মারা গেছেন ১৭ জন। বাস্তবতা হলো, লক ডাউনের আগে আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনাতেই প্রতিদিন মারা যেতো তারচয়ে বেশি মানুষ। কিন্তু যেভাবেই মারা যাক, একজন মানুষ মারা গেলেও আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি, অসম্ভব কষ্টের।

আশার কথা হলো, ইউরোপে মৃত্যুর হার কমছে। চীনে প্রায় জিরোর কাছাকাছি চলে গেছে এবং কানাডাতেও সে অবস্থার সুসংবাদ আছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে, লকডাউনে কাজ দিচ্ছে। আসলে এ মূহুর্তে লক ডাউন ছাড়া আমাদের আর কোন প্ল্যান ‘বি’ নেই। আমাদের ইতোমধ্যে বহু ভুল হয়ে গেছে। আমাদের সমন্বয়ের অভাবে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বারাবার পাবলিক গ্যাদারিংয়ে যেতে হয়েছে। ধর্মপ্রাণ সরল মানুষেরা বারবার সম্মিলতি প্রার্থনাতে মিলিত হয়েছেন। পরিবহন সেক্টরে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গ্যাদারিং হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এছাড়া অন্য বহুপেশার মানুষ লকডাউনের নিয়ম মানেননি। কিন্তু আমাদের আর না মানার সুযোগ নেই। ১৬৪ জন রোগী থাকার অর্থ হলো আমাদের ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভাইরাস ছড়িয়েছে এবং এখনো ছড়ানোর আরো বেশি সম্ভাবনা আছে। তাই আমাদেরকে এখন সরকারের প্রতিটি নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে, মানতে হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই।

পৃথিবীতে কোন মহামারীই অনন্তকাল ধরে থাকেনা। এগুলো হঠাৎ আসে আবার হঠাৎ চলেও যায়। তাই ভয় নয়, সচেতন থাকুন। আপনি আপনাকে বাঁচিয়ে মৃতের সংখ্যা কমাতে সাহায্য করুন। নিজেকে এবং পরিবারকে বাঁচাতে ঘরে থাকুন। অর্থনীতিতে কোন স্পন্দন নেই। তাই সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। অপচয় রোধ করতে হবে, কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে এবং ঘরে থাকতে হবে। না হলে সামনে মহাসংকট অপেক্ষা করছে।

গোলাম সারোয়ার
গবেষক ও কলামিস্ট।


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.