কোম্পানীগঞ্জ (নোয়াখালী) প্রতিনিধি :: বিছানার সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে কঙ্কালসার দেহটি। নাকে নল লাগানো। এই নল দিয়ে ওষুধ এবং খাবার খাওয়ানো হয়। ১৬ মাস ধরে অচেতন অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) পড়ে আছে দেহটি। তবে আইসিইউর মনিটর জানান দিচ্ছে ‘এখনো প্রাণ আছে।’
ওপরের বর্ণনা এক তরুণীর। নাম রিহাম আফসানা। স্বজন ও বন্ধুরা তাঁকে চামেলি নামে ডাকে। ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর কবিরহাট সড়কে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন আফসানা। তখন নোয়াখালী সরকারি কলেজের স্নাতক গণিত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন তিনি। স্নাতক প্রথম বর্ষে প্রথম শ্রেণিতে পাস করেন তিনি। সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে বাস ধাক্কা দিলে দুর্ঘটনার শিকার হন। একই দুর্ঘটনায় মারা যান আফসানার চাচাতো বোন সায়মা আফনান। বিয়ের ১ মাস ১৭ দিনের মাথায় মারা যান সায়মা।
আফসানা থুতনি, দাঁত, বাঁ হাত এবং মাথায় আঘাত পান। দুর্ঘটনার পর থেকে অচেতন আফসানাকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে, পরে ১২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেই থেকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রয়েছে আফসানা। মেয়ের সঙ্গে মা-বাবার ঠিকানাও এখন হাসপাতাল। বিশ্রামাগারের একটি কোণে তাঁদের থাকা-খাওয়া।
মেয়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সহায়সম্বল বিক্রি করে এখন প্রায় নিঃস্ব বাবা মিজানুর রহমান। তাঁর তিন মেয়ে এক ছেলের মধ্যে আফসানা তৃতীয়। বাড়ি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরকাঁকড়া ইউনিয়নে। একসময় তিনি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে থাকতেন। ২০০৮ সালে দেশে এসে বাড়ির পাশে দোকান দেন। মেয়ের চিকিৎসার জন্য প্রথমে দোকান পরে জমিটি বিক্রি করতে হয়েছে তাঁকে।
আফসানার বাবা মিজানুর রহমান বলেন, ‘মেয়ের চিকিৎসার জন্য এখন পর্যন্ত আমার ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। দোকান ও জমি বিক্রি করে পেয়েছিলাম ৯ লাখ টাকা। কিছু জমানো টাকা ছিল। বাকিটা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে সাহায্য আর ধারদেনা করে জোগাড় করি। প্রতিদিন দেড় হাজার টাকার মতো খরচ হচ্ছে। কীভাবে মেয়েকে বাঁচাব জানি না।’ সেদিনের দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘মেয়ে কলেজ থেকে সিএনজি করে বাড়ি ফিরছিল। সঙ্গে আমার বড় ভাইয়ের মেয়ে সায়মা। ফেরার আগে সকালে আমাকে ফোন করে বলেছিল, আব্বু আমি বাড়ি ফিরছি। ওটাই শেষ কথা। পরে বেলা পৌনে দুইটার দিকে ফোন এল, বাসের ধাক্কায় তাদের সিএনজি চুরমার। ঘটনাস্থলেই সায়মা মারা যায়।’ বলতে বলতে গলার স্বর থেমে যায় মিজানুরের।
দুর্ঘটনার পর থেকে পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যায় পরিবারটি। স্নাতকে পড়া আফসানার একমাত্র ভাই ইফতেখারের পড়ালেখাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ইফতেখার এখন একটি দোকানে চাকরি নিয়েছেন। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট বোন নানার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। সে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। কিন্তু মন পড়ে থাকে হাসপাতালে। প্রায়ই ফোনে খোঁজ নেয় বোনের।
মা জিন্নাতুননেছা দিনের বেশির ভাগ সময় মেয়ের শয্যার পাশে থাকেন। তিনি ক্লান্ত হলে বাবা মেয়ের দেখাশোনা করেন। রাতে মেয়ের শয্যার পাশে মেঝেতে ঘুমান। বাবা থাকেন হাসপাতালের বিশ্রামকক্ষে।
জিন্নাতুননেছা বলেন, ‘কেবল মেশিনের মাধ্যমে বোঝা যায় আমার মেয়ের প্রাণ আছে। চার-পাঁচ দিন আগে থেকে ডাকলে একটু তাকায়। আশায় বুক বেঁধে আছি মেয়ে ভালো হবে। ঘর-সংসার ফেলে এই হাসপাতালে রাতদিন পড়ে আছি।’ মেয়ে কোনো একদিন ‘আব্বু-আম্মু’ বলে ডেকে উঠবে এই আশায় মিজানুর দম্পতি কিছুক্ষণ পর পর মেয়ের কানের কাছে গিয়ে ‘চামেলি মা চামেলি মা’ বলে ডাকেন।
হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক প্রণয় দত্ত বলেন, আফসানা চোখ মেলে তাকালেও এখনো জ্ঞান ফেরেনি। নিকট অতীতে চমেক হাসপাতালে এত দিন আইসিইউতে কোনো রোগী ছিল বলে চিকিৎসকদেরও মনে পড়ে না।
১৬ মাস ধরে চিকিৎসাধীন আফসানার চিকিৎসায় চিকিৎসক-নার্সদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি দেখেননি বলে জানান তাঁর মা-বাবা।